About NITOR

RIHD – NITOR
অর্থোপেডিক সার্জারী চিকিৎসা শাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মধ্যে একটি। বাংলাদেশে অর্থোপেডিক সার্জারী যাত্রা মহান মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও RIHD (Rehabilitation Institute and Hospital for the Disabled) তথা NITOR (National Institute of Traumatology and Orthopaedic Rehabilitation)’র গোড়া পত্তনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশে অর্থোপেডিক সার্জারীর সূতিকাগার NITOR, যা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রথমে RIHD নামে প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীসময়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের লক্ষ্য নিয়ে।

স্বাধীনতার পূর্বে এদেশে অর্থোপেডিক চিকিৎসার কোন পূর্ণাঙ্গ বিভাগ বা অর্থোপেডিক সার্জারীর এদেশীয় কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিল না। ১৯৬৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম অর্থোপেডিক ইমার্জেন্সি ইউনিট গঠিত হয় এবং পরবতীর্তে ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। যেখানে কাজ করতেন যথাক্রমে ডাঃ ওমর আহমেদ জামাল ও ডাঃ সিরাজ উদ্দিন নামের দু’জন সার্জন যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় এবং স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই দেশ ত্যাগ করেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীসময়ে ১৯৭২ সালে হাজারো দেশপ্রেমিক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসার বিষয়টি একটি মানবিক সংকটের কারণ হয়ে দাড়ায়।এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে স্বল্প কিছু সংখ্যককে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়।কিন্তু তাদের অধিকাংশই এবং সাথে সাথে সাধারণ জনগণের একটা বিশাল অংশ  যারা যুদ্ধাহত ও আঘাতজনিত কারণে আহত বা বিকলাঙ্গ  তারা দেশেই থেকে যান রাষ্ট্র কতৃর্ক চিকিৎসার মুখাপেক্ষী হয়ে। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতির জনক বিশ্বের প্রথিতযশা অর্থোপেডিক সার্জনদের আহ্বান জানান এদেশে তাদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারীর প্রথমার্ধে আমেরিকার মিশনারী অর্থোপেডিক সার্জন De. R. J. Garst তাঁর স্ত্রী Merrie Garst কে নিয়ে ভারতের লুধিয়ানা থেকে বাংলাদেশে আসেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে। ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী Edward Richard George Heath এর সহায়তায় আরো আসেন Dr. J. N. Wilson.

Dr. R. J. Garst এদেশে এসে তৎকালীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও স্বাস্থ্য সচিব ড. টি হোসেন এবং তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী এর সাথে স্বাক্ষাত করে তাঁর কর্মপন্থা বিষয়ে সার্বিক রূপরেখা নির্ধারণ করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের অর্থোপেডিক ইমারর্জেন্সী ইউনিটে চিকিৎসা সেবা প্রদানের মাধ্যমে তাঁর কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু সেখানে এত বিপুল সংখ্যক রোগীর স্থান সংকুলান না হওয়ায় তিনি সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় তৎকালীন শেরে বাংলা নগর হাসপাতাল (বর্তমানে শহীদ সোহরাওয়াদীর্ হাসপাতাল) এর আউটডোর বিল্ডিং এ ১০০ শয্যার নতুন অর্থোপেডিক ইউনিট চালু করেন, যা “মুক্তিবাহিনী হাসপাতাল” নামে পরিচিত ছিল। পরে জুলাই ১৯৭৩ সালে এটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত হয় । এই হাসপাতালটি পরিচালিত হতো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত প্রথিতযশা অর্থোপেডিক সার্জন, নার্স, প্লাস্টিক সার্জন, এ্যাসেনথেসিয়া বিশেষজ্ঞ, ফিজিওথেরাপিস্ট ও অন্যান্য পেশার স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারা, যারা মানবিকতার টানে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, হংকং, সিংঙ্গাপুর, ভারত ও অন্যান্য দেশ থেকে ছুটে আসেন এই পঙ্গু ও আহত রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য। “মুক্তিবাহিনী হাসপাতাল” টি ১২ মে, ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল।

বাংলাদেশে আসার পর পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে Dr. R. J. Garst বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন এদেশের কিছু চিকিৎসককে অর্থোপেডিক সার্জারীতে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে পাঠানোর জন্য। এ প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালের মে মাসে ৫ জন চিকিৎসক (ডাঃ মোঃ শামসুদ্দীন আহমেদ, ডাঃ রুহুল আমিন, ডাঃ বদরুদ্দোজা, ডাঃ কে. এম. আলম ও ডাঃ মোমিন উল্লাহ), ১৭ জন নার্স ও ১২ জন লিম্ব মেকার’কে প্রশিক্ষণের জন্য তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে পাঠানো হয়। উল্লেখ্য, সে সময় অবধি বাংলাদেশের পাসপোর্ট চালু না হওয়ায় বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা “ট্রাভেল ডকুমেন্ট” এর মাধ্যমে অল্প কিছুসংখ্যক ডলার দিয়ে তাদেরকে পাঠানো হয়। পরবতীর্তে তারা দেশে ফিরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও অন্যান্য দুস্থ রোগীর সেবায় আত্মনিয়োগ করেন।

বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে সার্বিক পরিস্থিতি অবলোকন করে Dr. R. J. Garst, Dr. J. N. Wilson ও তৎকালীন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আলোচনায় বসে সিদ্ধান্ত নেন যে, আহত ও বিকলাঙ্গ রোগীদের অর্থোপেডিক চিকিৎসা সেবা প্রদানের পাশাপাশি এদেশের ডাক্তারদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ অর্থোপেডিক সার্জন তৈরী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতঃবসরে Dr. R. J. Garst স্বীয় প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৫ ই মার্চ ১৯৭৩ সনে অর্থোপেডিক সার্জারীতে প্রথমে ৫ বছর মেয়াদী এম. এস. কোর্স এবং সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সনে সাড়ে তিন বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা কোর্স চালু করেন। এটি ছিল স্বাধীনতা পরবর্তীকালে চিকিৎসা শিক্ষায় এদেশে প্রথম পোষ্ট গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী।

২৮ এপ্রিল, ১৯৭৪ সালে National Economic Council (NEC) এর প্রকল্পের অধীনে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষে নতুন ৭৫ টি ক্যাজুয়ালিটি শয্যাসহ অর্থোপেডিক বিভাগ সমৃদ্ধ মোট ৩২৫ শয্যার শহীদ সোহরাওয়াদীর্ হাসপাতাল যাত্রা শুরু করে। একই সাথে ৪০০ শয্যার স্বতন্ত্র অর্থোপেডিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কাজও শুরু করা হয় এবং Dr. R. J. Garst কে মাত্র ২ ডলার মাসিক সম্মানীতে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। Dr. R. J. Garst ও সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অত্যন্ত দ্রুত গতিতে নিমার্ণ কাজ শেষে এপ্রিল, ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশের প্রথম স্বতন্ত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল, Rehabilitation Institute and Hospital for the Disable (RIHD) যাত্রা শুরু করে যা স্বল্প সময়ে সারাদেশের মানুষের কাছে “পঙ্গু হাসপাতাল” নামে সুপরিচিতি লাভ করে। এই হাসপাতালে Dr. R. J. Garst এর নেতৃত্বে গঠিত “Red Unit” এর মাধ্যমে অর্থোপেডিক চিকিৎসা কার্যক্রম আরম্ভ হয়। শুরুর দিকে Dr. R. J. Garst এর আহবানে এবং Overseas Development Administration এর কার্যক্রমের আওতায় ইংল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ থেকে প্রথিতযশা অর্থোপেডিক সার্জনগণ এই হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে চিকিৎসাসেবা দিতে আসতেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাজ্যের Dr. Eyre Brook, Dr. Walker, Dr. Louise, Dr. John, Sir Dr. Gay Pulverteft, Dr. E. L. Trickey, Dr. Berton Powell, অষ্ট্রেলিয়ার Dr. Mershall, কানাডার Dr. Hubert, স্কটল্যান্ডের Dr. J. M. C. Gibson, যুক্তরাষ্ট্রের Dr. Ditmenson, Dr. R. Seinji, ভারতের Dr. Parvez Bazlail, Dr. P. N. Sood সহ প্রায় শতাধিক। তাদের পাশাপাশি নার্সিং সেবা প্রদানের জন্য ডেনমার্কের সিস্টার D. J. Madson ও ভারতের Sister Theodre এর নাম উল্লেখ্যযোগ্য। এছাড়া এসেছেন ফিজিওথেরাপিষ্টরাও, যাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য Valery N Tailor । ১৯৭৫ সালে ভারতীয় প্লাস্টিক সার্জন Dr. Parvez Bazlail RIHD তে দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্লাস্টিক সার্জারী চিকিৎসার গোড়া পত্তন করেন।

ধীরে ধীরে দেশে অর্থোপেডিক সার্জারীর কলেবর বৃদ্ধি পেতে থাকলে RIHD এর আরো মানোন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির অনুরোধে তৎকালীন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার ডাঃ এম. এ. মালেকের নির্দেশে ২ সেপ্টেম্বর, ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, NITOR ।

২৪ এপ্রিল, ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজায় সংঘটিত ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্ঘটনায় আহতদের দেখতে নিটোর পরির্দশনকালে তৎকালীন পরিচালক ও বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির মহাসচিব প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশে অর্থোপেডিক ও ট্রমা সার্জারীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর তুলনায় শয্যা ও চিকিৎসার অন্যান্য সুবিধাদির অপ্রতুলতার বিষয়টি অবহিত করে জরুরী ভিত্তিতে নিটোরের সম্প্রসারণের জন্য পেশকৃত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অনুরোধ জানালে তিনি তাৎক্ষণিক ভাবে তা পরবর্তী একনেক (ECNEC) সভায় উপস্থাপনের নির্দেশ প্রদান করেন এবং পরবর্তী একনেক (ECNEC) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটির দ্রুত সমাপ্তির পর গত ২৯ শে অক্টোবর ২০১৮ইং তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা NITOR এর সম্প্রসারিত ভবনের উদ্ভোধন করেন এবং নতুন ভবনের নীচতলায় বহিঃবিভাগ, রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগ পরির্দশন করেন। ১০০০ শয্যার এই হাসপাতালটি কেবল বাংলাদেশেই নয়  সারা বিশ্বে সরকারী বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সর্ববৃহৎ ইনস্টিটিউট এবং একমাত্র পূণার্ঙ্গ অর্থোপেডিক ও ট্রমা হাসপাতাল। বর্তমানে সম্প্রসারিত এই পূর্ণাঙ্গ অর্থোপেডিক হাসপাতালের কার্যক্রম আরো বিস্তৃত। এখানে চালু করা হয়েছে ২৯টি অপারেশন থিয়েটার। ডিপার্টমেন্ট অব প্লাষ্টিক এন্ড রিকনস্ট্রাক্টিভ সার্জারী সহ সাম্প্রতিক কালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আর্থোপ্লাষ্টি, স্পাইন সার্জারী, আর্থোস্কোপি, পেডিয়াট্রিক অর্থোপেডিকস, ইলিজারভ এন্ড ডিফরমেটি কারেকশন, হ্যান্ড সার্জারী, মাসকুলো ইস্কেলেটাল অনকো সার্জারী সহ প্রায় ১০ টি সুপার স্পেশালিটি সার্ভিস। পাশাপাশি এনেস্থেশিয়া, রেডিওলজি ইমেজিং, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন, ল্যাবরেটরি মেডিসিন, কার্ডিওলজি, ভাস্কুলার সার্জারী, মেডিসিন, এন্ডোক্রাইনোলজি, নেফ্রোলজি, ইউরোলজি, নিউরো মেডিসিন, নিউরো সার্জারী, ফিজিক্যাল মেডিসিন ও ফিজিও থেরাপি বিভাগ সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ সমূহ চালুর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’। বঙ্গবন্ধুর পৃষ্টপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত, Dr. R. J. Garst ও Merie Garst এর হাতে গড়া এই প্রতিষ্ঠানটি আজ পরিণত হয়েছে দেশের আহত ও পীড়িত মানুষের পরম নির্ভরতার আশ্রয় স্থল।

নিটোর এর সুপরিসর স্থাপনা, সুদৃশ বাগান শোভিত বহুপ্রজাতির পুষ্প বৃক্ষরাজির সমাহার, আভ্যন্তরীন সুপরিচ্ছন্ন ওয়ার্ডে দৃষ্টিনন্দন আবহ রোগীদের মনস্তাত্বিক প্রশান্তি নিশ্চিত করেছে। নিবেদিত প্রাণ চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মযজ্ঞের স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা বলতেই পারি-

NITOR – OUR PROUD
ORTHOPAEDIC SURGEONS – OUR PROUD